হঠাৎ করেই মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে যায় তরী'র। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে রুহিত বিছানায় নেই। ওঠে বসে তরী। বেড সুইচটা অন্ করে রুমের চারপাশটা তাকিয়ে দেখে। আলনা থেকে চাদরটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয় সে। দরজাটা টান দিতেই খুলে যায়।
বাইরে কুয়াশার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাঝরাতের নিসত্দব্ধতা চারপাশের পরিবেশটাকে অদভুত ভুতুড়ে করে রেখেছে। এ মাঝ রাতে কোথায় যেতে পারে রুহিত? একটু যেন শিউরে ওঠে তরী। প্রথম ফাল্গুনের কনকনে শীতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। তরী দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে বিছানায় আশ্রয় নেয়। রুহিতের গনত্দব্যস্থান কি হতে পারে- এ চিনত্দায় ঘুমটা চোখের তারা থেকে পালিয়ে যায়। বিছানায় চুপটি করে শুয়ে থাকে তরী। এক ধরনের বিষন্নতার ভারে নেতিয়ে পড়ে সে। পঞ্চইন্দ্রীয় প্রতীক্ষায় থাকে রুহিতের। প্রতীৰার প্রহরগুলো কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। দেয়াল ঘড়িটা টিক্ টিক্ শব্দ তুলে আপন গতিতে ছুটে চলে। স্মৃতি রোমন্থনে মগ্ন হয় তরী।
স্কুলের আঙিনা পেরিয়ে সবে কলেজে পা রেখেছে তরী। আপন মনে এক অন্যরকম অনুভুতিকে সঙ্গী করে হাজির হয় কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে। অনাবিল আনন্দ আর ভাললাগায় হৃদয়টা ছুঁয়ে যায় তরীর। সে অনুষ্ঠানেই রুহিতকে প্রথম দেখে সে। রুহিত এ কলেজেরই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার ভরাট কণ্ঠে কাজী নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার আবৃত্তি মুগ্ধ করে তরী'কে। এক আশ্চর্য আবেশ এসে ধাক্কা দিয়ে যায় তরীর সকল শিরা-উপশিরায়। অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন ছোটাছুটিতে ব্যসত্দ তখন সম্বিত ফিরে পায় সে। জীবন চলার পথে হৃদয়ের ডায়েরীতে নির্মল বিশুদ্ধতায় কিছু কিছু স্মৃতি আমৃতু্য জেগে থাকে; যা কখনো পুরনো বা মলিন হয় না বরং প্রতিনিয়ত উজ্জ্বলতার ক্যানভাসে আলোকদীপ্ত হয়ে ওঠে। তরীও কলেজের সে দিনটির স্মৃতি বিশেষ করে রুহিতের আবৃত্তির আবেশটুকু হৃদয়ের গোলাপী অলিন্দে অনুরাগের ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখে। কলেজের প্রতিটি দিন রুহিতের জাদুকরী কণ্ঠের ডাক পেতে, তার একটু সানি্নধ্য পেতে অপার ব্যগ্রতায় কাটায় তরী। হঠাৎ করেই একটা সুযোগও এসে যায়। কলেজ থেকে একটি বার্ষিকী বেরোবে। আর তার জন্য লেখা জমা দিতে হবে রুহিতের কাছে। নোটিশ বোর্ডে নোটিশটা দেখে তরী তখনই সিদ্দানত্দ নেয়, বার্ষিকীর জন্য একটা কিছু লিখতেই হবে। বাসায় ফিরে তরী কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়ে। কাগজ আর কলমের সেকি যুদ্ধ! একবার লিখে তো আরেকবার ছিঁড়ে। এক সময় কবিতা ধরা দেয় তরীকে। দুরু দুরু বুকে পরদিন কলেজে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে জমা দেয় রুহিতের হাতে। রুহিত কাগজের ভাঁজ খুলে যখন চোখের সামনে তরীর লেখাটি মেলে ধরে, সে সময় তরীর হৃদস্পন্দন যেন হঠাৎ করেই বেড়ে যায়।
তরী।
রুহিতের ডাকে হঠাৎ করেই যেনো শিহরিত হয়ে ওঠে তরীর দেহ-মন। এ ডাকটি শোনার জন্য তরী এতদিন হৃদয়ের সমসত্দ উপলব্ধি দিয়ে প্রতীৰার প্রহর গুণলেও হঠাৎ করেই সে কেমন যেন হত-বিহ্বল হয়ে যায়। রুহিতের মুখের দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছিল না সে। মাথাটা নিচু করে উত্তর দিল- জি্ব।
তোমার কবিতাটা অনবদ্য হয়েছে। চমৎকার লেখার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
তরীর মাঝে যেন হঠাৎই এক বিরাট ঝড় বয়ে যায়। কি বলবে বুঝতে পারে না সে। বিধ্বসত্দ তরীকে এবার পাশ থেকে রৰা করে তার বান্ধবী কলি। সে বলে ওঠে, তাহলে আমরা আসি।
রুহিতের সামনে থেকে এভাবে বিদায় নিলেও তরী মনে মনে ভাবে, আসলে এটা তো কবিতা নয়, এটা তোমার জন্য আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা, রুহিত। আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমি তো জানি।
কলেজ বার্ষিকীতে কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর রুহিত নিজ থেকেই তরীর সঙ্গে কথা বলে। সে কথা বলার সূত্র ধরে ক্রমেই দু'জনের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠতে থাকে। একসময় দু'জনের হৃদয়ের বন্ধনে দু'জন বাঁধা পড়ে যায় এবং অবশেষে দু'জনের ভাললাগা আর ভালবাসাটা পরিণয়ে রূপ নেয়।
মসজিদে মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠের আযানের ধ্বনি তরীর ভাবনায় ছেদ টানে। বিছানা ছেড়ে ওঠে বারান্দায় পায়চারী করতে থাকে তরী। রুহিতের এভাবে বেরিয়ে যাওয়ার কোন উদ্দেশ্য খুঁজে পায় না তরী। চিন্তা ক্রমশ বিসতৃতির সঙ্গে প্রতীক্ষায় প্রহরগুলো অসহ্য ঠেকে তরীর। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে পূর্বগগণে ঠিকই সূর্যদেব উঁকি মারার প্রস্তুতি নেয়। তরী দাঁত ব্রাশ করে কিছুটা ফ্রেশ হয়ে অলস হাতে দু'জনের জন্য নাসত্দা তৈরি করে। রোজকার মতো দুজনের জন্য নাসত্দা সাজিয়ে তরী রুহিতের জন্য অপেৰা করতে থাকে। এ সময়টাতে রুহিত মর্নিং ওয়াক সেরে গোসল করে এসে তরীকে নিয়ে এক সঙ্গে সকালের নাসত্দা সারে। তরী নাসত্দার টেবিল সাজিয়ে বসে আছে তো আছেই, রুহিতের ফেরার নামটি পর্যনত্দ নেই। তরী একবার দরজার সামনে আবার নাসত্দার টেবিলে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে। তার এ অস্থিরতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা করে করে সময় ক্রমাগত ছুটতে থাকে। সময়ের এ ছুটে চলার মাঝে রুহিতের না ফেরা তরীকে বিচলিত করে তোলে। মাঝরাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এখন প্রায় দুপুর হয়ে এলো, অথচ রুহিত বাসায় ফিরে আসেনি। এখন অন্যরকম শঙ্কায় পেয়ে বসে তরীকে। গেটের বাইরে এসে রিক্সা নেয়। সম্ভাব্য সব স্থানে রুহিতের খোঁজ করে। কিন্তু কোথাও রুহিতের কোন সন্ধ্যান মিলেনা। ঘন্টা দুয়েক খোঁজাখুঁজির পর রুহিতের খোঁজ না পেয়ে বিপর্যসত্দ অবস্থায় বাসায় ফিরে তরী।
প্রথম ফাল্গুনের রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমে আসে। গাছের নতুন পাতার ফাঁকে একটা-দুটো কোকিল কুহু কুহু স্বরে অনবরত ডেকে চলে। ডাইনিং রোমে ঢুকতেই টেবিলের উপর দুজনের জন্য সাজিয়ে রাখা নাস্তা চোখে পড়ে। অশ্রু আর বাঁধ মানে না তরীর। শাড়ির আঁচলে দুচোখ ঢেকে কেঁদে ওঠে তরী। অশ্রুধারায় সিক্ত হয় তরী। দৌড়ে বেডরোমে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলে তরী। রুহিতের এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কোন কারণ দাঁড় করাতে পারে না তরী। বার বার তরীর কানে রুহিতের একটি কথাই বাজে, তরী। তোমার ভালবাসা আমাকে ভালবাসতে শিখিয়েছে, তোমার সে ভালবাসার অতলে ডুব দিয়ে আমি ভালবাসার গভীরতাকে পরিমাপ করতে জেনেছি। তোমার হৃদয় দিয়ে আমাকে হৃদয়বান করেছো। তোমাকে কি ভুলে যাওয়া বা দূরে ঠেলে দেয়া যায়?
রুহিতের স্মৃতিগুলো তরীকে পলে পলে বিদ্ধ করে চলে। বাইরে পাখিদের নীড়ে ফেরার ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে আসে। আচমকা কারো পায়ের শব্দে চমক ভাঙে তরীর। এই বুঝি রুহিত এলো! চোখের কোণায় চিক্ চিক্ করে ওঠে অশ্রুজল। বিছানা ছেড়ে বুঝতে পারে, এ তার অবচেতন মনের কল্পনা বৈ কিছু নয়। টেবিলের নিকট থেকে টান দিয়ে চেয়ারটায় বসতে যেতেই তরীর দৃষ্টি টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দেয়া কাগজটার দিকে নিবন্ধ হয়। উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপতে থাকে তরী। কাঁপা হাতে তাড়াতাড়ি কাগজটা নিয়ে ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরে তরী।
তরী,
তোমার কাছে এ লেখাটা যখন লিখছি তখন তুমি গভীর ঘুমে। তোমার ঘুমনত্দ নিষ্পাপ মুখটার দিকে একবারের বেশি তাকাতে সাহস পাইনি। পাছে তোমার ভালবাসার কাছে বরাবরের মতো আবারও পরাজিত হই। আজীবন তোমার ভালবাসা শুধু স্বার্থপরের মতো দুহাতের অঞ্জলি ভরে গ্রহণই করেছি। আজ যখন সময়ের দাবি এসেছে, প্রাণের আবেগে তোমাকে 'তরী' বলে ডাকবার কিংবা তোমার ভালবাসার মাঝে আমার ভালবাসাকে উৎসর্গ করবার, তখন আর পিছন ফিরে তাকাতে পারিনি। আমি চাই তোমাকে আমি যেভাবে বিশুদ্ধ উচ্চারণে 'ভালবাসি' কথাটি বলে এসেছি; সেভাবে অনাগত প্রেমিক-প্রেমিকা তার প্রিয়জনকে, আমাদের অনাগত সনত্দান তোমাকে-আমাকে 'ভালবাসি' কথাটি বলার স্বীকৃতি পাক। তুমিই বলো, একি আমার কোনো অন্যায় চাওয়া? তাইতো বিপস্নবী ঝান্ডা হাতে তোমার জন্য ভালবাসার অমর কাব্য সাজাব বলেই ঘর থেকে বেরিয়েছি। তুমি আমাকে ভুল বোঝ না, তরী। আমি তোমার ভালবাসার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেই তোমার কাছে ফিরে আসব।
তোমারই,
রুহিত
তরী কাগজটাকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে হো হো করে কেঁদে ওঠে। তরীর দু'চোখ বেয়ে অশ্রু অঝর ধারায় ঝরছে আর ঝরছে। সন্ধ্যার কালো কোকিলটির মতো তরীও জানতে পারলো না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তার স্বামী রুহিত মায়ের ভাষার জন্য রাজপথে রক্ত ঢেলে তরীকে শেষবারের মতো 'ভালবাসি' কথাটি বলে গেছে।।
০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪